চন্দ্রিমা উদ্যান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র সংসদ ভবনের পাশে অবস্থিত। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধি এখানে অবস্থিত। সমাধিকে কেন্দ্র করে এখানে সমাধি কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী এই উদ্যানটি এবং লেকটি দেখতে আসেন। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাতঃভ্রমণকারীদের জন্য এটি একটি উত্তম স্থান। ঢাকা শহরের উদ্যানগুলির মধ্যে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যান।
নামকরণ
প্রথম দিকে এই উদ্যানের নামকরণ করা হয়েছিল “চন্দ্রিমা উদ্যান”। এই নামকরণের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু মতামতও পাওয়া যায়। কারো কারো মতে, এখানে চন্দ্রিমা নামে একজনের বাড়ি ছিল, সেখান থেকেই এই নামের উৎপত্তি। আবার কারো কারো মতে, দক্ষিণপাশে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ক্রিসেন্ট লেকের সাথে মিল রেখে রাষ্ট্রপতি এরশাদ এর নাম চন্দ্রিমা উদ্যান রেখেছিলেন। দীর্ঘদিন একে গবাদিপশুর খামার, খাস জমি এবং চাষাবাদ জমি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে এই স্থানে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সমাধিস্থ করা হয় এবং এলাকাটিকে পরিষ্কার করে দর্শণার্থীদের জন্য মনোরম স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হয়। পরবর্তী সময়ে মরহুম জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে একে জিয়া উদ্যান নামকরণ করেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জিয়া উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে আবার চন্দ্রিমা উদ্যান করেছিল। পরে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেটার নাম পরিবর্তন করে জিয়া উদ্যান নাম করে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার আবার নাম পরিবর্তন করে চন্দ্রিমা উদ্যান রেখেছে। এখন এই স্থানটি কারো কাছে চন্দ্রিমা উদ্যান আবার কারো কাছে জিয়া উদ্যান নামে পরিচিত।
অবস্থান ও আয়তন
চন্দ্রিমা উদ্যানটি শেরে বাংলানগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। চন্দ্রিমা উদ্যানের দক্ষিণে জাতীয় সংসদ ভবন, উত্তরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ও বাণিজ্যমেলার মাঠ, পশ্চিমে গণভবন এবং পুর্বে তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দর অবস্থিত। এটির অবস্থান । এ উদ্যানটি ৭৪ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত।
সমাধি কমপ্লেক্স
চন্দ্রিমা উদ্যান ও জিয়াউর রহমানের সমাধি কমপ্লেক্স দেশের একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। প্রতিদিন ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন এই সমাধি কমপ্লেক্স ও উদ্যান দেখার জন্য। চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের সমাধি কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু হয় ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে। ৭৪ একর জমির সবুজ শ্যামলিমায় এর অবস্থান। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। সমাধির পুর্ব ও পশ্চিমে রয়েছে ক্যান্টিন, দক্ষিণে ঝুলন্ত সেতু, উত্তরে মেমোরিয়াল হল ও মসজিদ।
ক্রিসেন্ট লেক ও ফোয়ারা
জিয়াউর রহমানের সমাধির দক্ষিণ পাশে ক্রিসেন্ট লেক অবস্থিত। এটি বাঁকা চাঁদের মত দেখতে বিধায় ক্রিসেন্ট লেক নাম রাখা হয়েছে। এটির দক্ষিণ পাশে চমৎকার করে সিঁঁড়ি তৈরি করা হয়েছে ও দর্শণার্থীদের বসার স্থান করা হয়েছে চারপাশজুড়ে। ভিতরে প্রবেশের জন্য লেকের মাঝখান দিয়ে তৈরি হয়েছে মনোরম সেতু। ক্রিসেন্ট লেকের মাঝে ঝুলন্ত সেতুর দুই পাশে দুটি ফোয়ারা রয়েছে। সন্ধ্যার পর ফোয়ারাগুলো চালু করা হলে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা ঘটে।
খোলা চত্বর
বাগানের মধ্যে রয়েছে খোলা চত্বর, যা ওপেন থিয়েটার বা পথ নাটকের জন্য একটি আদর্শ স্থান। পূর্ব ও পশ্চিম অক্ষ বরাবর সুদৃশ্য দু’টি ল্যান্ডস্কেপের মাধ্যমে করা হয়েছে এই খোলা চত্বর। উদ্যানে যারা প্রাত্যহিক ভ্রমণ, বিশ্রাম বা সমাধি জিয়ারতের জন্য আসেন তাদের জন্য রাস্তাগুলো তৈরি রয়েছে আলাদাভাবে। এখানে টয়লেট, বিশ্রামাগার, ফাস্টফুডের দোকান, বসে বিশ্রাম নেয়ার জন্য চমৎকার সব বেঞ্চ রয়েছে। বসার স্থানগুলোয় সাদা পাথর বসানো হয়েছে। রোদ-বৃষ্টিতে দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি হয়েছে ছাউনি। সমাধি কমপ্লেক্সে রাখা হয়েছে অত্যাধুনিক সিসিটিভি ক্যামেরা। কম্পিউটারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায় পুরো এলাকার নিরাপত্তা ও সাউন্ড সিস্টেম। রাস্তায় লাইট পোস্টের সঙ্গে রয়েছে গোপন সাউন্ড বক্স, যা এখানে আসা দর্শণার্থীদের জন্য এক নতুন চমক। বিভিন্ন সময় বক্সগুলোতে বাজানো হয় কোরআন তেলাওয়াত, দেশাত্মবোধক গান ইত্যাদি। এ ধরনের সাউন্ড বক্স সেতু ও সমাধির চারপাশেও সংযোজন করা হয়েছে।
পুকুর
জিয়াউর রহমানের সমাধির পূর্ব ও পশ্চিম পাশের উদ্যানের ভেতরে আছে দু’টি পুকুর। এ দু’টি পুকুরকে সংস্কার করে দর্শনীয় করার জন্য শানবাঁধানো ঘাট করা হয়েছে। আগেই পুকুরের মাঝখান দিয়ে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। ওই সময় প্রকৌশলীরা এগুলো অর্নামেন্টাল ব্রিজ বা অলঙ্কারিক সেতু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। প্রকৌশলীরা ওই সময় পুকুরগুলোকে ইলিপস বা ডিম্বাকৃতির রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। যদিও শেষ পর্যন্ত পুকুরের ওপরের সেতুগুলো নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি।
শরীর চর্চা নিয়ে উদ্যান
প্রতিদিন প্রভাত বেলা ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পযর্ন্ত এখানে চলে বিভিন্ন দলে, বিভিন্ন নামে ভাগ হয়ে গ্রুপ ভিত্তিক শরীরচর্চা। এখানে যে সব শরীরচর্চার গ্রুপ গুলো আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্রুপ হচ্ছে প্রায় ১০০০ সদস্যের “চন্দ্রিমা ফিটনেস ক্লাব”, যা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ফিটনেস ক্লাব হিসাবে পরিচিত। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে শরীরচর্চাবিদ ওস্তাদ আমির হোসেনের আন্তরিক নিদের্শনার মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ ফ্রিতে এক সাথে ৪০০ থেকে ৫০০ জন লোক নিয়মিত সকালে ব্যায়াম করেন এই ক্লাবে। যেখানে দেশের সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে চালের আড়তদার পর্যন্ত সবাই এক কাতারে, একই সাথে শরীরচর্চা করে থাকেন। এই ক্লাবের একটি আলোচিত শ্লোগান হলো “সকাল বেলার হাওয়া, কোটি টাকার দাওয়াহ্”। এছাড়া ইন্সট্রাক্টর সেলিমের নির্দেশনায় “শুভ্র সকাল” প্রায় ১০০ সদস্যকে শরীরর্চচা করায়। এছাড়া ছোট ছোট দল গুলোর মধ্যে “ভোরের শিশির”, “বন্ধন ফিটনেস ক্লাব”, “প্রভাতে চন্দ্রিমা”, “ভোরের শিশির ফিটনেস ক্লাব”, “চন্দ্রিমা আলাপন ফিটনেস ক্লাব” উল্লেখযোগ্য। প্রতি শুক্রবার টাকার বিনিময়ে শরীরর্চচা ও কারাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে “ডায়মন্ড মার্শাল আর্ট ট্রেনিং সেন্টার”। এছাড়া আছে বাচ্চাদের স্কেটিং শেখার সুব্যবস্থা।
সার্বিক ব্যবস্থাপনা
চন্দ্রিমা উদ্যানের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ত্বে রয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনটি বিভাগের উপর পার্কের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রয়েছে।
- গণপূর্ত: পার্কের কাঠামোগত যাবতীয় নির্মাণ এবং দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে এই বিভাগ।
- আরবারি কালচার: মাঠের গাছপালা লাগানো, এগুলোর যত্ন নেয়া, ঘাস লাগানো ও পরিচর্যা ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে এই বিভাগ।
- ইলেক্ট্রনিক্স: বৈদ্যুতিক যাবতীয় কর্মকাণ্ড এই বিভাগের দায়িত্বে রয়েছে। এছাড়া লেক এবং পুকুরের মাছের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে এই বিভাগ।
পার্কের বিভিন্ন বিষয় তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন একজন কার্য সহকারী। ১০ জন মালি উদ্যানটির গাছপালা পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করছেন। তারা পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তাদের বেতন স্কেল হল ৪১০০ টাকা। শাখা অফিসারের মাধ্যমে তারা বেতন পেয়ে থাকেন।